জেমস এ উপমহাদেশের অন্যতম সেরা রকস্টার। পুরো নাম মাহফুজ আনাম জেমস। ভক্তকুলে যার মূল পরিচিতি ‘গুরু‘ হিসেবে। আর ভক্তদের তিনি আদর করে ডাকেন, ‘দুষ্টু ছেলের দল’ হিসেবে।
দেশ ছাড়িয়ে আর্ন্তজাতিক অঙ্গনে নগরবাউল জেমস নামেই তার অধিক পরিচিত। এ পর্যন্ত দেশের সবচেয়ে দামি সংগীত তারকা হিসেবে অভিহিত করা হয় তাকে।
সংস্কৃতিবানেরা ফেসবুকে সংস্কৃতি ডটকমের পেইজে লাইক দিন এখানে ক্লিক করে।
কখনো কনডেম সেলে ফাঁসির আসামীর মৃত্যুর দিন গোনার হাহাকার, কখনোবা বঞ্চিত শ্রমিকের বিপ্লবী জীবন, আশা-হতাশার খাতায় লেনদেনের গড়মিল চিৎকার করে উঠেছে তার কণ্ঠে। তার ভরাট কণ্ঠে বঙ্গবন্ধু হেঁটে যান মহামানবের মতো, তার কণ্ঠের টানে বখাটে ঘরে ফিরেছে বহুবার।
তার মাতাল কণ্ঠের উন্মাদনায় ঘর ছেড়েছে বহু বহু নাম না জানা প্রেমিকা, বিরহে কাতর প্রেমিকের বুকফাটা আর্তনাদে বেরিয়ে এসেছে, ‘আমি তারায় তারায় রটিয়ে দেবো তুমি আমার’। তার গানে বাবা-মায়ের প্রতি সন্তানকে করেছে আরও নমনীয়, কোমল।
১৯৬৪ সালের ২ অক্টোবর নওগাঁয় জন্মগ্রহণ করেন জেমস। তার বেড়ে ওঠা চট্টগ্রামে। জেমসের জীবন বেশ বাঁক বদলের, অনেক গল্পের, অনেকটা তার গানের মতই। তার বাবা ছিলেন একজন সরকারি কর্মচারি, যিনি পরবর্তীতে চট্টগ্রাম শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ছেলেবেলা থেকেই তাঁর গানের সাথে গড়ে ওঠে সখ্যতা। সপ্তম শ্রেণীতে পড়া অবস্থায় হাতে তুলে নেন গিটার।
গানের প্রতি প্রচন্ড আকর্ষণ তাঁর পড়াশোনায় ব্যাঘাত ঘটায়। তাই গান করা নিয়ে তাঁর বাবার ছিল প্রচন্ড আপত্তি। পরিবারের অমতেই সংগীত চর্চা শুরু করেন জেমস। বাবার সঙ্গে গান নিয়ে অভিমান করে বাড়ি ছেড়ে চলে আসেন। সংগীতের নেশায় ঘর ছেড়ে পালিয়ে যান। চট্টগ্রামের আজিজ বোর্ডিং নামক একটি বোর্ডিং-এ তিনি থাকতে শুরু করেন। সেখানে থেকেই তার সংগীতের ক্যারিয়ার শুরু হয়। সারাদিন কেটে যেত তাঁর গান তৈরিতে আর সন্ধ্যা গড়ালে চলে যেতেন নগরীর নাইট ক্লাবে গান গাইতে।
সে সময় তিনি ও তাঁর ব্যান্ড ইংরেজি কাভার গান করতেন। ইংরেজি কাভার গান ছেড়ে তাঁরা একসময় নিজেদের সৃজনশীল মৌলিক বাংলা গান করার জন্য ঢাকা চলে আসেন।
১৯৮০ সালে প্রতিষ্ঠা করেন ‘ফিলিংস’ নামক একটি ব্যান্ড। জেমস নিজেই ব্যান্ডের প্রধান গিটারিস্ট ও ভোকালিস্ট ছিলেন। ১৯৮৭ সালে তার প্রথম অ্যালবাম ‘ষ্টেশন রোড’ প্রকাশ পায়। যদিও অ্যালবামটি সে সময়ের শ্রোতাদের গান শোনার রুচির সাথে একটু ভিন্ন মেজাজের হওয়ায় জনপ্রিয়তা পায়নি। তবে এর ‘আগের জনমে’, ‘আমায় যেতে দাও’ এবং ‘রূপসাগর’ গান তিনটি কিছুটা জনপ্রিয় হয়েছিল। পরে ১৯৮৮ সালে ‘অনন্যা’ নামের অ্যালবাম রিলিজ করেন। এ অ্যালবামও তেমন জনপ্রিয়তা পায়নি। যেই সঙ্গীতের জন্য ঘর ছাড়া, এত সাধনা, সেই সঙ্গীত যেন জেমসকে ভালোবেসে বুকে টেনে নিচ্ছিল না। তাই কিছুটা হতাশা চেপে ধরলো তাকে।
তবে ‘অনন্যা’ প্রকাশের চার বছর পর শুরু হলো জেমস ঝড়। বুকের ভেতরকার সব দুঃখ, হতাশা যেন আগুন হয়ে বেরিয়েছিল ১৯৯৩ সালের ‘জেল থেকে বলছি’ অ্যালবামে। ফিলিংস ব্যান্ডের প্রথম সাফল্য, সেই সঙ্গে জেমসের দাপটের সূচনা। এই অ্যালবামের টাইটেল গানটি দেশজুড়ে তুমুল জনপ্রিয়তা লাভ করেছিল। তরুণদের মাঝে জেমস পরিণত হলেন নতুন ক্রেজে।
এরপর ১৯৯০ সালে ‘জেল থেকে বলছি’, ১৯৯৬ ‘নগর বাউল’, ১৯৯৮ সালে ‘লেইস ফিতা লেইস’, ১৯৯৯ সালে ‘কালেকশন অফ ফিলিংস’ অ্যালবামগুলো ফিলিংস ব্যান্ড থেকে বের হয়। ১৯৯৬ সালে ফিলিংস ব্যান্ড থেকে ‘নগরবাউল’ প্রকাশের পর সেটি ব্যাপক সফলতা পেয়েছিল। সেই সুবাদে ২০০০ সালে ব্যান্ডের নাম ফিলিংস থেকে নগরবাউল রাখেন জেমস। নগর বাউল ব্যান্ড থেকে প্রকাশ করেন ‘দুষ্টু ছেলের দল’ (২০০১), ‘বিজলি’।
জেমসের একক অ্যালবামের ক্যারিয়ার গ্রাফ এমন—‘অনন্যা’ (১৯৮৮), ‘পালাবে কোথায়’ (১৯৯৫), ‘দুঃখিনী দুঃখ করোনা’ (১৯৯৭), ‘ঠিক আছে বন্ধু’ (১৯৯৯), ‘আমি তোমাদেরই লোক’ (২০০৩), ‘জনতা এক্সপ্রেস’ (২০০৫), ‘তুফান’ (২০০৬) এবং ‘কাল যমুনা’ (২০০৮)।
এরপর থেকে প্লেব্যাকের বাইরে ব্যান্ড বা একক কোনও গানে পাওয়া যায়নি জেমসকে। জেমস চলচ্চিত্রে প্লেব্যাক করেও সফল হয়েছেন। তার বেশ কিছু গান চলচ্চিত্রে সুপারহিট হয়ে আছে। ‘দেশা দ্য লিডার’, ‘সত্তা’ ছবির জন্য গান করে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারও পেয়েছেন তিনি। ‘কষ্ট’ সিনেমায় ‘দশমাস দশদিন’, ‘মনের সাথে যুদ্ধ’ সিনেমায় ‘আসবার কালে আসলাম একা’, ‘নারীর মন’ সিনেমায় ‘মীরাবাঈ’, ‘দেশা দ্য লিডার’ সিনেয়াম্য ‘দেশা আসছে’, ‘সত্তা’ সিনেমায় ‘তোর প্রেমেতে অন্ধ হলাম’, ‘আগুন আমার নাম’ সিনেমায় ‘পাগলা হাওয়ার তরে’, ‘ওয়ার্নিং’ সিনেমায় ‘এত কষ্ট কষ্ট লাগে কেন অন্তরে’ এবং ‘সুইটহার্ট’ সিনেমায় ‘বিধাতা’ গানগুলো শ্রোতাদের অসামান্য ভালোবাসা পেয়েছে।
জেমসের গাওয়া অন্যান্য জনপ্রিয় গানগুলোর মধ্যে রয়েছে- ‘তারায় তারায়’, ‘লেইস ফিতা লেইস’, ‘সুলতানা বিবিয়ানা’, ‘সুস্মিতার সবুজ ওড়না’, ‘হতেও পারে এই দেখা শেষ দেখা’, ‘কবিতা তুমি স্বপ্নচারিণী’, ‘দুস্টু ছেলের দল’, ‘দিদিমনি’, ‘দুঃখিনী দুঃখ করোনা’, ‘তোর সব কিছুতে নয় ছয়’, ‘বাবা কত দিন দেখি না তোমায়’, ‘গুরু ঘর বানাইলা কী দিয়া’, ‘লিখতে পারি না কোনো গান’, ‘এক নদী যমুনা’ ইত্যাদি।
জেমসের জনপ্রিয়তা শুধু দেশে নয়, আর্ন্তজাতিক পরিমণ্ডলেও ব্যাপক জনপ্রিয় নগরবাউল ব্যান্ডের এই তারকা। পাশের দেশ কলকাতাতেও সেই নব্বই দশক থেকে একটি প্রজন্ম বেড়ে উঠেছে, গান করেছে তাকে অনুসরণ করে।
বাংলা গানের পাশাপাশি হিন্দি গানে কণ্ঠ দিয়েও জয় করেছেন লক্ষ ভক্ত শ্রোতার হৃদয়। বলিউডে গাওয়া জেমসের গানের মধ্যে রয়েছে ‘ভিগি ভিগি (গ্যাংস্টার)’, ‘চল চলে (ও লামহে)’, ‘আলবিদা (রিপ্রাইস)’, ‘রিশতে (লাইফ ইন এ মেন্ট্রো)’, ‘বেবাসি (ওয়ার্নিং থ্রিডি)।
সংগীতে অবদানের জন্য ‘জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার’, ‘মেরিল-প্রথম আলো পুরস্কার’, ‘সিটিসেল-চ্যানেল আই মিউজিক অ্যাওয়ার্ডস’সহ দেশ-বিদেশের আরও অনেক পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন জেমস।
গানের বাইরে জেমস একজন মডেল হিসেবেও কাজ করেছেন। তার প্রথম বিজ্ঞাপন ছিল পেপসির। ২০০০ সালের দিকে সেই বিজ্ঞাপন প্রচারে এসেছিল। আর দেশজুড়ে জনপ্রিয়তা পেয়েছিল। এরপর তিনি ২০১১ সালে এনার্জি ড্রিং ব্ল্যাক হর্সের বিজ্ঞাপনে কাজ করেছেন। রেড ডট এন্টারটেইনমেন্ট নামে একটি প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান রয়েছে তার।
গানের বাইরেও গেল ক’বছর জেমস মন বসিয়েছেন ছবি তোলায়। তার ফটোগ্রাফির বিষয়, মডেল, নাগরিক জীবন ও প্রকৃতি। যে ছবিগুলোর মাধ্যমে নেটিজেনদের গানের তৃষ্ণা অনেকটাই মেটান ছবিয়াল জেমস।
আরও পড়ুন : শাহ আবদুল করিম : বাউল সম্রাট।
* আপনার লেখা পাঠিয়ে দিন parthibrashed@ymail.com এ।