ফ্রানৎস কাফকা , মাত্র ৯টি গল্প, ৪০টি পূর্ণাঙ্গ রচনা, ৩টি অসমাপ্ত উপন্যাস, কিছু ডায়েরি, চিঠি, নোটবুক যাকে করে তুলেছে বিংশ শতাব্দির সবচেয়ে প্রভাবশালী লেখক।
উইলিয়াম শেক্সপিয়ারের পরে আর কোনো লেখককে নিয়ে এত আলোচনা, লেখালেখি বা গবেষণা হয়নি। মাত্র এই কয়েকটি লেখা দিয়েই বিশ্বসাহিত্যের অনেক লেখককে প্রভাবিত করেছেন তিনি। তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য- হোর্হে লুই বোর্হেস, আলবেয়ার কাম্যু, মিলান কুণ্ডেরা, গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজ, হারুকি মুরাকামি, ভ্লাদিমির নভোকব, হোসে সারামাগো ও জঁ-পল সার্ত্র।
শারীরিক এবং মানসিক নিষ্ঠুরতা, বিচ্ছিন্নতাবোধের আদিরূপ, পিতা-মাতা-সন্তানের দ্বন্দ্ব, আতঙ্ক, আমলাতন্ত্রের গোলকধাঁধা আর রহস্যময় রূপান্তরকে কেন্দ্র করেই আবর্তিত হয়েছে কাফকার অধিকাংশ রচনা৷ সমাজের বিভিন্ন দিক, বিভিন্ন সময় উদ্ভট রূপ পেয়েছে তাঁর উপন্যাসে, ছোট গল্পে৷ তিনি অস্তিত্ববাদ দ্বারা বিশেষভাবে প্রভাবিত ছিলেন। তার সবচেয়ে আলোচিত কাজ হল ডি ভারভাণ্ডলাঙ্গ (দ্য মেটামরফসিস)।
‘দ্য মেটামরফোসিস’ বা রূপান্তর উপন্যাসের প্রধান চরিত্র এক ভ্রাম্যমাণ বিক্রেতা গ্রেগর সামসা৷ একদিন সকালে ঘুম ভাঙলে তিনি এক কিম্ভূতকিমাকার বিরাট পোকার রূপে নিজেকে আবিষ্কার করেন৷ তারপর থেকেই শুরু হয় অসহনীয় এক পরিস্থিতি৷ পরিবারের আর্থিক সচ্ছলতার কারণে তাঁর বিক্রেতার চাকরি হারান এবং ধীরে ধীরে গোটা পরিবারের সহানুভূতিও হারান তিনি৷ হয়ে ওঠেন অবাঞ্ছিত৷ এক সময় মারা যান তিনি৷ ঘরের পরিচারিকারা ময়লার সাথে বাইরে ফেলে দিয়ে আসেন তাঁকেও৷
তাঁর উপন্যাস বা গল্পের চরিত্র প্রায়ই পক্ষপাতিত্ব, লজ্জা এবং অপরাধবোধ বা এমন বাজে অভিজ্ঞতার শিকার হয়েছেন৷ ‘দ্য ট্রায়াল’ গল্পের কথাই ধরা যাক৷ সেখানে ব্যাংক কর্মচারী ইয়োসেফকে এক সকালে গ্রেপ্তার হলেন বিরাট কোনো অপরাধ না করেই এবং শেষ পর্যন্ত তিনি জানতেই পারলেন না তাঁর বিরুদ্ধে আসল অভিযোগটা কী৷ এমনকি বিচারকের সামনেও তাঁকে দাঁড়াতে দেয়া হয়নি৷
কাফকা অস্ট্রিয়া-হাঙ্গেরি সাম্রাজ্যের প্রাগের (বর্তমানে চেক প্রজাতন্ত্রের রাজধানী) একটি মধ্যবিত্ত জার্মান-ইহুদি পরিবারে ১৮৮৩ সালে ৩ জুলাই জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবা হারমেইন কাফকা ও মা জুলি। ব্যবসা নিয়ে বাবা-মার ব্যস্ততার কারণে তার শৈশব একাকীত্বে কাটে। বাবার সঙ্গে তার সম্পর্কের বড় ধরনের টানাপোড়ন ছিল। ১৯৮৯ সাল থেকে ১৯৯৩ সাল পর্যন্ত কাফকা ডয়েচ ক্যানাবেনশুল জার্মান বয়েজ এলিমেন্টারি স্কুলে পড়েন। এখানকার পড়ালেখার সঙ্গে ইহুদি শিক্ষার ইতি ঘটে। এরপর একটি প্রথাগত মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি হন। ১৯০১ সালে উচ্চমাধ্যমিক সম্পন্ন করেন।
১৯০১ সালে প্রাগের জার্মান চার্লস-ফার্দিনান্দ বিশ্ববিদ্যালয়ে রসায়নে ভর্তি হন। তবে দুই সপ্তাহ পর বিষয় বদলে আইনে ভর্তি হন। দুটি কারণে ভর্তি হন- আইন পেশায় যথেষ্ট সম্ভাবনা থাকায় বাবা খুশি হবেন ও অনেকদিন বিশ্ববিদ্যালয়ে থাকা যাবে। এ সময়ে প্রিয় বিষয়গুলো (ইতিহাস, কলা ও জার্মান) নিয়ে কোর্স করতে পারবেন। ১৯০৬ সালের ১৮ জুলাই আইনে ডক্টরেট ডিগ্রি পান। পরের ১ বছর আদালতে বাধ্যতামূলক বেতনহীন কেরানির চাকরি করেন।
প্রথমবর্ষের শেষদিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের আরেক ছাত্র ম্যাক্স ব্রডের সঙ্গে পরিচিত হয়। তাদের বন্ধুত্ব আজীবন অটুট ছিল। ব্রডকে কাফকা বলেছিলেন, মৃত্যুর পর যেন সব লেখা পুড়িয়ে ফেলা হয়। তবে ব্রড সে কথা রাখেননি। দুজনে মিলে মূল গ্রিক ভাষায় প্লেটোর ‘প্রোটাগোরাস’ ও ফরাসিতে ফ্লবেয়ারের ‘সেন্টিমেন্টাল এডুকেশন’ ও ‘দ্য টেম্পটেশন অব সেইন্ট এন্টনি’ পড়েন। দস্তয়েভস্কি, ফ্লবেয়ার, ফ্রানৎস গ্রিলপারসার ও হাইনরিখ ফন ক্লাইস্টকে কাফকা রক্তের ভাই ভাবতেন। গ্যেটেকে খুব পছন্দ করতেন। পাস্কাল, শোপেনহাওয়ার, সেইন্ট অগাস্টিনের ‘কনফেশনস’ ও টলস্টয়ের খ্রিষ্টীয় ডায়েরিগুলো পড়েন। অস্তিত্ববাদী দার্শনিক সোরেন কির্য়েকেগার্ড কাফকার ওপর সবচেয়ে বেশি প্রভাব ফেলে।
তিনি দুটি প্রতিষ্ঠানে চাকরি ও একটি বড় ব্যবসায়িক উদ্যোগে যুক্ত ছিলেন। ১৯০৭ সালের ১ নভেম্বর থেকে ১৯০৮ সালের ১৫ জুলাই পর্যন্ত ইতালিয়ান বীমা কোম্পানিতে কাজ করেন। কম বেতন ও লেখালেখির জন্য সময় না পাওয়া তার জন্য কষ্টের কারণ হয়ে উঠে। এরপর সরকারি বীমা প্রতিষ্ঠানে কাজ করেন। তার কাজ ছিল কারখানার শ্রমিকরা কাজ করতে গিয়ে আহত হলে, সে সব দুর্ঘটনার তদন্ত ও ক্ষতিপূরণ নির্ধারণ। পারিবারিক ও কর্মক্ষেত্রের অভিজ্ঞতাগুলোর ছাপ পাওয়া যায় তার লেখায়।
১৯১১ সালে এক ইদ্দিশ নাট্যদলের নেতা ইজাক লাউভির সঙ্গে বন্ধুত্ব হয়। ১৯১১ সালের অক্টোবরে দলটির নাটক দেখে টানা ছয় মাস ইদ্দিশ ভাষা ও সাহিত্য পড়েন। সরকারি কাজের কারণে ১৯১৫ সালের প্রথম বিশ্বযুদ্ধে তাকে অংশগ্রহণ করতে হয় না। তবে ১৯১৭ সালে সেনাবাহিনীতে যোগ দেওয়ার আগ্রহ দেখালেও যক্ষ্মার কারণে ফলপ্রসূ হয়নি। ১৯১৮ সালে অফিস শারীরিক অসুস্থতার কারণে পেনশন মঞ্জুর করে। এরপরের ছয়টি বছর নানা স্যানাটোরিয়ামে (স্বাস্থ্যনিবাস) কাটে।
তার লেখালেখির মধ্যে রয়েছে- গল্প, উপন্যাস, স্যাটায়ার, প্রবন্ধ ও চিঠি। তার সব লেখা জার্মান ভাষায় লিখিত। তবে এখানে ইংরেজি অনুবাদের নাম ব্যবহার করা হল। ১৮৯০ সালে ‘কনভারসেশন উইথ দ্য সাপ্লিকান্ট’ ও ‘কনভারসেশন উইথ দ্য ড্রাঙ্কেন ম্যান’ নামে দুটি লেখা হাইপেরিয়ন নামে সাময়িকীতে প্রকাশিত হয়। ওই বছরই বিখ্যাত বোহেমিয়া পত্রিকায় ছাপা হয় ‘দ্য এরোপ্লেন অ্যাট বেসিকা’। ১৯১০ সালে বোহেমিয়ায় অনেকগুলো লেখা লিখেন, যেগুলো পরে ‘মেডিটেশন’ বইয়ে অন্তর্ভুক্ত হয়। ১৯১২ সালে সাহিত্য পত্রিকা হেরদের ব্লাতারে ‘রিচার্ড অ্যান্ড স্যামুয়েল’ উপন্যাসের প্রথম পরিচ্ছেদ প্রকাশিত হয়। ওই বছর ‘আমেরিকা’ উপন্যাসটি লেখা শুরু করেন। লিখেন গল্প ‘দ্য জাজমেন্ট’। ১৯১৩ সালে ‘মেডিটেশন’ প্রকাশিত হয়। ‘দ্য জাজমেন্ট’ গল্পটি প্রকাশ হয় ‘আর্কেডিয়া’ নামে সাময়িকীতে। ওই বছর লিখেন তার শ্রেষ্ঠ বড় গল্প ‘দ্য মেটামরফিসিস’। ১৯১৪ সালে ‘ইন দ্য পেনাল কলোনি’ বড় গল্পের প্রথম খসড়াটি লিখেন, লিখেন ‘দ্য জায়ান্ট মোল’। শুরু করেন ‘দ্য ট্রায়াল’ উপন্যাস। ১৯১৮ সালে লিখেন বিখ্যাত গল্প ‘দ্য গ্রেট ওয়াল অব চায়না’। ১৯১৯ সালে প্রকাশিত হয় গল্প সংকলন ‘এ কান্ট্রি ডক্টর’। ১৯২০ সালে প্রকাশিত হয় ‘ইন দ্য পেনাল কলোনি’। ১৯২১ সালে টাটরার স্বাস্থ্য নিবাসে শেষ করেন শ্রেষ্ঠতম উপন্যাস ‘দ্য ক্যাসেল’। প্রাগার প্রেসে পত্রিকায় প্রকাশিত হয় ‘দ্য বাকেট রাইডার’। ১৯২২ সালে প্রকাশিত হয় বিখ্যাত ছোটগল্প ‘এ হাঙ্গার আর্টিস্ট’। ১৯২৩ সালে লিখেন ‘ইনভেস্টিগেশনস অব এ ডগ’, ‘দ্য বারোজ’ ও ‘যোসেফিন দ্য সিঙ্গার’। জীবদ্দশায় মোট সাতটি বই প্রকাশিত হয়। মৃত্যুর পরে ‘দ্য ট্রায়াল’, অসম্পূর্ণ ‘আমেরিকা’ ও ‘দ্য গ্রেট ওয়াল অব চায়না’ প্রকাশিত হয়। ম্যাক্স ব্রডের সম্পাদনায় ১৯১০-২৩ সাল পর্যন্ত লেখা দিনলিপি ও ভ্রমণলিপি প্রকাশিত হয়। ব্রড কাফকার জীবন অবলম্বনে লিখেন উপন্যাস ‘দ্য কিংডম অব লাভ’।
কাফকার কাজের অনেকগুলোই বাংলায় অনূদিত হয়েছে। সবচেয়ে বড় কাজটি করেছেন মাসরুর আরেফিন। তার অনুবাদে কাফকার লেখার বড় অংশ প্রকাশ করেছে পাঠক সমাবেশ।
বেশ কয়েকবার প্রেমে পড়ে বাগদান হলেও কোনোটি বিয়েতে গড়ায়নি। প্রথম প্রেমিকা ফেলিস বাউয়ারকে লেখা ৫০০ চিঠির একটি সংকলন পাওয়া যায়। যাকে বলা হয় কাফকার মানসিক অবস্থার এক রক্তাক্ত ছবি। ফেলিসের সঙ্গে সম্পর্ক চলাকালে গোপনে ফেলিসের বান্ধবী গ্রেটে ব্লখের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তোলেন। ১৯২০ সালে অসুস্থ অবস্থায়ই প্রেমে পড়েন চেক সাংবাদিক ও লেখক মিলেনা ইয়েসেনস্কার। তাকে লেখা চিঠিগুলোও বই আকারে প্রকাশিত হয়।
মিলেনার সঙ্গে সম্পর্ক চলার সময়েই হোটেল পরিচারিকা ইউলি ওরিৎসেকের প্রেমে পড়েন। তার শেষ প্রেমিকার নাম ডোরা ডিয়ামান্ট। মৃত্যুর মাস দশেক আগে ১৯২৩ সালের আগস্টে ডোরার সঙ্গে তার পরিচয় হয়। দুজনে পরিকল্পনা করেন প্যালেস্টাইনে গিয়ে সংসার শুরু করবেন ও একটা রেস্টুরেন্ট খুলবেন। কিন্তু তার আগে কাফকা মারা যান। পরে ডোরা বেশ নামকরা অভিনেত্রী হন। কাফকার মৃত্যুর সময় ডোরা পাশে ছিলেন।
বিশ শতকের অন্যতম ঔপন্যাসিক ও ছোটগল্পকার ফ্রানৎস কাফকা অস্ট্রিয়ার কারলিংয়ে ১৯২৪ সালের ৩ জুন মারা যান।
ফেসবুকে সংস্কৃতি ডটকমের পেইজে লাইক দিন এখানে ক্লিক করে।
আরও পড়ুন : আলবেয়ার কামু ও অ্যাবসার্ড তত্ত্ব