অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাক ‘শিক্ষকদের শিক্ষক’ নামে খ্যাত। তাকে চলমান বিশ্বকোষ বলা হয়ে থাকে।
অর্থনীতি, রাজনীতি, সাহিত্য, সংস্কৃতি, সমাজবিজ্ঞান, ইতিহাস, বিজ্ঞান, ধর্ম ও রান্নাসহ নানা বিষয়ে তার অগাধ পাণ্ডিত্য ছিল। সত্যিকার একজন পণ্ডিত ব্যক্তি বলতে যা বোঝায় তার সকল গুণ বিদ্যমান ছিল তার মধ্যে।
সংস্কৃতিবানেরা ফেসবুকে সংস্কৃতি ডটকমের পেইজে লাইক দিন এখানে ক্লিক করে।
হাসিমাখা মুখে ঢাকাইয়া ভাষায় কথা বলা ছোটখাট এই মানুষটির জ্ঞান ছিল পর্বততুল্য। তিনি তার নিজস্ব ঢঙ এবং বুলিতেই কথা বলতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করতেন, যেটা পুরোপুরি ঢাকাইয়াও না, আবার গ্রাম্যও না। তিনি ইংরেজিটা বেশ ভালো এবং বিশুদ্ধভাবে বলতে পারতেন, কিন্তু মাতৃভাষাকে প্রাধান্য দিতেন সবচাইতে বেশি। আর তার ছাত্রদেরও তিনি মাতৃভাষার উপর লেখালেখি করার উৎসাহ দিতেন। তিনি বলতেন,
মাতৃভাষা ছাড়া কোনো জাতি বা কারো উন্নতি করা সম্ভব নয়।
পোশাক-আশাকের ব্যাপারেও তার বাঙালিয়ানা প্রকাশ পেতো। কেননা খদ্দরের পাঞ্জাবী-পায়জামা আর মাঝে মাঝে কাঁধে একটি চাদর কিংবা লুঙি আর কুর্তাতেই বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করতেন। কেবলমাত্র অতীব জরুরি প্রয়োজন, যেমন- বিলেত গমন বাদে কোট-টাই পরতে তার প্রচুর অনীহা ছিল।
ফুলার রোডের লাল ইটের দোতলা এক বাসায় থাকতেন, যেখানে সবসময় তার ছাত্র-ছাত্রীদের যাতায়াত ছিল। ছাত্র-ছাত্রীদের সাথে জ্ঞানের আড্ডা ছিল তার কাছে অত্যন্ত পছন্দের ব্যাপার। জ্ঞানের ভারে ন্যুজ্ব এই ব্যক্তি জ্ঞান বিলাতেই সবচাইতে বেশি ভালোবাসতেন। বই পড়া এবং সংগ্রহ করা বাদে তার আরো দুটি নেশা ছিল, আর তা হচ্ছে বাজার করা এবং রান্না করা।
তার বাসায় প্রতিনিয়ত যেসব ছাত্র-ছাত্রীর যাতায়াত ছিল, তাদের প্রায় প্রত্যেকেই তার হাতের রান্না খেয়েছেন এবং প্রশংসা করেছেন। তিনি শুধুমাত্র জ্ঞানের শিক্ষক ছিলেন না, অনেক ছাত্রী, এমনকি অনেক ছাত্রের বউয়ের রান্নার শিক্ষকও ছিলেন। রান্না করার বইয়ের বিশাল সংগ্রহ ছিল তার। বাজার করতেন বেশ সময় নিয়ে। প্রায়ই তিনি বলতেন,
আমি যেকোনো দেশে গেলেই দুটি জিনিস দেখি। এক কাঁচাবাজার, অন্যটা হলো বইয়ের দোকান। আমার মনে হয়, কাঁচাবাজার আর বইয়ের দোকান সম্ভবত সমাজের অবস্থার সবচেয়ে উৎকৃষ্ট নির্দেশক। যে দেশে বইয়ের দোকান নাই সে দেশে লেখাপড়া খুব হয় তা বিশ্বাস করি না। কাঁচাবাজার দেখলেই বোঝা যায়, দেশের অবস্থা কেমন। বইয়ের দোকানে গিয়ে কী ধরনের বই পাওয়া যায়, কেমন বিক্রি হয়, তা দেখেই দেশের জ্ঞানচর্চার অবস্থা বোঝা যায়। একবার তুরস্কে গিয়েছিলাম। সেখানে বইয়ের দোকানে শতকরা ত্রিশ-পঁয়ত্রিশটা বই কম্যুনিজম সম্পর্কে, শতকরা ত্রিশ-পঁয়ত্রিশটা বই ইসলাম সম্পর্কে। সুতরাং সেই দেশে যে টেনশন থাকবে তা বোঝার জন্য হাফেজ হওয়ার দরকার নাই।
আবদুর রাজ্জাক ১৯১৪ সালের ১ জানুয়ারি ঢাকার নবাবগঞ্জ উপজেলার পারাগ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর বাবা আব্দুল আলি একজন পুলিস অফিসার ছিলেন। তিনি ঢাকার মুসলিম গভর্নমেন্ট হাই স্কুল থেকে মেট্রিক এবং ঢাকা কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট পাস করেন। ১৯৩১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনৈতিক অর্থনীতি বিভাগে ভর্তি হন। ১৯৩৬ সালে প্রথম শ্রেণীতে মাস্টার্স পাস করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনৈতিক অর্থনীতি বিভাগে প্রভাষক হিসেবে যোগ দেন।
তিনি লন্ডন স্কুল অব ইকোনমিক্সে বিশ্ববিখ্যাত প্রফেসর হ্যারল্ড লাস্কির অধীনে পিএইচডি করতে যান। তার থিসিসের শিরোনাম ছিলো ‘পলিটিক্যাল পাটি ইন ইন্ডিয়া’। হ্যারল্ড লাস্কি মারা যাওয়ায় তার থিসিস মূল্যায়ন করার মত কেউ নেই এই বিবেচনায় থিসিস জমা না দিয়েই বাংলাদেশে ফিরে আসেন। তবে অনেকে বলেন পিএইচডির প্রতি বিতৃষ্ণার কারণে তিনি থিসিস জমা দেননি।
১৯৫০ সালে তিনি দেশে ফিরেন। ১৯৫৯ সালে হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় তাকে ভিজিটিং ফেলো হিসেবে যোগ দেয়ার আহবান জানায়। তিনি ১৯৭৫ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সিনিয়র প্রভাষক হিসেবে অবসর গ্রহণ করেন। একই বছর সরকার তাকে জাতীয় অধ্যাপক হিসেবে মনোনীত করে। ১৯৭৩ সালে দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয় তাকে ডি লিট ডিগ্রি প্রদান করে।
অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাক চল্লিশ বছর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেছেন। বিলিয়ে দিয়েছেন নিজের জ্ঞান আর নিজেকে সকলের তরে। তাকে বলা হতো শিক্ষকদের শিক্ষক। তবুও তার শিক্ষকতাকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েই ‘আব্দুর রাজ্জাকের কল্লা চাই’ স্লোগান উঠেছিল। আর যে বিশ্ববিদ্যালয় তার মতো ছাত্র আর শিক্ষক পেয়ে ধন্য হয়েছে সেই বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষই তার বিরুদ্ধে দুটি মামলা করেছিল।
অবশ্য দুটো মামলাতেই স্যারের জয় হয়েছিল। এ জয় ছিল বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনের শাসন-শোষণ আর স্বৈরাচারিতার বিরুদ্ধে। তবে শিক্ষক হওয়া সত্ত্বেও ক্লাস নেয়ার ব্যাপারে তার প্রচন্ড অনীহা ছিল। তিনি অকপটে স্বীকার করতেন, ক্লাস নেয়াটা তার ধর্তব্যের মধ্যে নেই। তিনি সবচাইতে বেশি আনন্দ পেতেন যদি ছাত্ররা কোনো বিষয়ে জানার অভিপ্রায়ে হোক আর এমনিতেই হোক তার কাছে এসে ঘণ্টার পর ঘন্টা আলাপ করে।
সত্যিকার শিক্ষক শুধু শিক্ষাদানই করেন না। ছাত্রদের বর্তমান, ভবিষ্যৎ নিয়েও ভাবেন। সস্নেহে চেয়ে থাকেন তার ছাত্রটি কবে মানুষের মতো মানুষ হবে। অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাক ছিলেন তেমনই একজন। দল-মত নির্বিশেষে সবাইকে সাহায্য করেছেন তিনি। কেউ যদি বলেন, স্যার এ সাহায্যটুকু করতে হবে। তখনই কাঁধে চাদরটা দিয়ে তাকে নিয়ে হাঁটা ধরতেন। কখনো কাউকে ‘তুমি’ করে বলেননি। সকল ছাত্রকে তিনি ‘আপনি’ সম্বোধন করতেন।
অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাক অল্প কিছু প্রবন্ধ ছাড়া কিছুই রচনা করেননি। ১৯৮০ সালে তিনি একটি বক্তৃতা দেন। বক্তৃতাটি তানভীর মোকাম্মেলের অনুবাদে ১৯৮১ সালে বই আকারে প্রকাশ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। বক্তৃতাটির শিরোনাম ছিলো ‘বাংলাদেশ : স্টেট অব দ্য নেশন’।
আহমদ ছফা তাকে নিয়ে ‘যদ্যপি আমার গুরু’ নামে একটি বই লিখেছেন। যা বাংলা সাহিত্যে উল্লেখযোগ্য সংযোজন। এছাড়া অধ্যাপক সরদার ফজলুল করিম তাঁর সঙ্গে আলাপচারিতার ওপর ভিত্তি করে লিখেছেন ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও পূর্ববঙ্গীয় সমাজ : অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাকের আলাপচারিতা’ নামের বই। ড. সলিমুল্লাহ খান কিছুটা সমালোচনামূলকভাবে লিখেছেন ‘বাংলাদেশের জাতীয় অবস্থার চালচিত্র’ নামের বই।
স্বাধীনতাপূর্ব ও স্বাধীনতাত্তোর বুদ্ধিজীবীদের বড় অংশ সরাসরি তার কাছ থেকে জ্ঞানগত সাহায্য পেয়েছেন। তার শ্রেণিকক্ষের ছাত্র না হয়েও তারা তাকে স্যার বলে সম্বোধন করেন এবং তাদের লেখালেখিতে তা উল্লেখ করেন। ২০১২ সালে বেঙ্গল পাবলিকেশনস থেকে প্রকাশিত স্মারকগ্রন্থে তাদের অনেকে আবদুর রাজ্জাককে নিয়ে লিখেছেন।
‘জ্ঞানতাপস আব্দুর রাজ্জাক’ নামে একটি ফাউন্ডেশন আছে, যেখান থেকে গবেষণারত শিক্ষার্থীদের জন্য অর্থ সাহায্য দেয়া হয়ে থাকে।ধানমন্ডি রবীন্দ্র সরোবরে স্যারের সংগ্রহে থাকা সকল দুর্লভ আর দুষ্প্রাপ্য বইসমূহ নিয়ে ‘জ্ঞানতাপস আব্দুর রাজ্জাক বিদ্যাপীঠ’ নামে একটি পাঠাগার চালু আছে। যেখানে শুধুমাত্র গবেষণালব্ধ জ্ঞান বাদেও ব্যক্তিগতভাবে জ্ঞানী হওয়ার জন্য সকলের আমন্ত্রণ।
অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাক ১৯৯৯ সালের ২৮ অক্টোবর ঢাকায় মৃত্যুবরণ করেন।
আরও পড়ুন : যে দশটি উপন্যাস জীবনে একবার হলেও আপনার পড়া উচিত।
1 comment
Comments are closed.